প্রস্তাবিত গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলী) আইন, ২০২১-এ গণমাধ্যম কর্মীদের চাকরির সুরক্ষা, সংশ্লিষ্ট সুবিধাদি ও অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি বলে মন্তব্য করেছে ট্রন্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
জাতীয় সংসদে উত্থাপিত বিলটির ওপর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় এই অভিমত ব্যক্ত করে বিলটি সংশোধনের জন্য এককভাবে মালিকপক্ষের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে, গণমাধ্যমকর্মী ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করারও দাবি জানানো হয়।গণমাধ্যমকর্মীদের আইনি সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করার কথা প্রস্তাবিত বিলে উল্লেখ করা হলেও কার্যত তার প্রতিফলন দেখা যায়নি, বরং খসড়াটি বৈষম্যমূলক বলে মন্তব্য করেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেছেন, ‘দ্বিতীয় ধারায় যে অল্প কয়েকটি সংজ্ঞা সন্নিবেশিত হয়েছে তাতে স্পষ্ট যে, এই খসড়া আইনটির আরও গভীর বিশ্লেষণ ও সংশোধন অপরিহার্য। গণমাধ্যমের ভূমিকা ও কর্তব্য বিবেচনায় নিলে গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরি যে বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে, তারও কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, শ্রম আইনে যে ন্যূনতম মানদণ্ড ঠিক করা হয়েছে শুধু সেগুলোকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করাকেই যথেষ্ট বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেখানেও একতরফাভাবে কাটছাঁট করা হয়েছে।’
উদাহরণ হিসেবে তিনি সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টা এবং ১ দিন সাপ্তাহিক ছুটি নির্ধারণের বিষয়গুলো উল্লেখ করেন। সরকার ঘোষিত দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটি বা দোকান, ব্যবসা বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য দেড় দিনের সাপ্তাহিক ছুটি এবং খাওয়া ও বিশ্রামের জন্য এক ঘণ্টার বিরতির বিষয়সমূহ বিবেচনা করা হয়নি, যা অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক।
প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে গণমাধ্যমকর্মীকে বিধি অনুযায়ী অতিরিক্ত ভাতা দিয়ে ৪৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে। কিন্তু শ্রম আইনে মূল বেতনের দ্বিগুণ ভাতা দেওয়া বা সপ্তাহে, মাসে বা বছরে সর্বোচ্চ কত ঘণ্টা অতিরিক্ত কাজ করানো যাবে সে সংক্রান্ত অংশটি বিবেচনা করা হয়নি।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকর্মীদের কাজের ধরন অন্য সব প্রতিষ্ঠানের থেকে আলাদা এই যুক্তি দেওয়া হলে, তাঁরা যে বাড়তি সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখেন-সেটাও স্বীকার করে নিতে হবে।’
আলোচ্য বিলের ১২ ধারায় গণমাধ্যম মালিকদের অতিরিক্ত কর্মী ছাঁটাই করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। করোনা মহামারির মাঝে দেশের প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ঢালাও কর্মী ছাঁটাই, বেতন-বোনাস কমিয়ে দেয়া, বেতন বন্ধ রাখার মতো ঘটনাগুলো উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘অতিরিক্ত’ বলতে কোন প্রেক্ষিতে কী বোঝানো হয়েছে, তা নিশ্চিত না করা হলে, গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরির সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
এছাড়া, ১৪ ধারায় অসদাচরণের সংজ্ঞা না দিয়েই এই অপরাধে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার বিপজ্জনক বিধান রাখা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
আর দশ বা ততোধিক গণমাধ্যমকর্মীর এক সঙ্গে চাকরি অবসানের ক্ষেত্রে ‘সার্বিক নিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে’ সরকারকে অবহিত করার মতো ধারার সন্নিবেশ গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য রীতিমতো অপমানজনক বলে মন্তব্য করেন ড. ইফতেখার।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরো বলছেন, ‘২৫ ধারায় ন্যূনতম ওয়েজ বোর্ড গঠনের বিষয়টি বাধ্যতামূলক না করে, সরকারের বিবেচনা ও ইচ্ছাধীন করা হয়েছে। অন্য ধারায় ন্যূনতম বেতন না দিলে মালিক পক্ষকে বাধ্য করার জন্য শাস্তির বিধান থাকলেও, এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, মালিক পক্ষ সরকারের সঙ্গে দেন দরবার করে ওয়েজ বোর্ড গঠনই আটকে দিতে পারে। একইভাবে ভবিষ্যৎ তহবিল গঠনের বিষয়টিও মালিক পক্ষের ইচ্ছাধীন রাখা হয়েছে।’
গণমাধ্যমকর্মী কল্যাণ সমিতি নামে সাংবাদিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার বিষয়টি থাকলেও, এ সংক্রান্ত বিধি-বিধান এই বিলে অনুপস্থিত।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, ‘এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিধি প্রণয়নের জন্য রেখে দেওয়াটা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়, বরং এটাকে ইচ্ছাকৃত বলে মনে করি। অবাক করার মতো বিষয় হলো, এই পুরো বিলের কোথাও সম্পাদক শব্দটির উল্লেখ পর্যন্ত নেই। গণমাধ্যমে যে ভিন্নভিন্ন পেশাজীবীরা কাজ করেন, তারও কোনো উল্লেখ নেই। তাই আইনটি শুধুমাত্র করতে হবে বলে করা হচ্ছে-এমনটা ভাবা অবান্তর হবে না।’
এমন বাস্তবতায় টিআইবি আশা করে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রস্তাবিত বিলটি ঢেলে সাজাবার কাজ শুরু করবেন এবং এই সংশোধন প্রক্রিয়ায় অবশ্যই সংবাদকর্মী ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে।