দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল আছে ১৫টি। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) নিয়ন্ত্রণাধীন এসব কলের অধিকাংশই স্বাধীনতার আগের। পুরোনো হওয়ায় কমে গেছে এসবের কার্যক্ষমতা। ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। চিনিকলগুলোর উৎপাদন বাড়াতে বিভিন্ন সময় নেওয়া হয়েছে নানান উদ্যোগ। তবে কাজে আসেনি কোনোটি।
নর্থবেঙ্গল ও ঠাকুরগাঁও চিনিকল আধুনিকায়নে খরচ হয়েছে ২২ কোটি টাকার বেশি। অথচ মাঝপথে বন্ধ প্রকল্প দুটির কাজ। নতুন করে চিনিকল দুটিতে অ্যালকোহলসহ নানা পণ্য উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের লক্ষ্য, বছরে ৯০ লাখ লিটার অ্যালকোহল উৎপাদন। এসব অ্যালকোহল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে শতকোটি টাকা আয় হবে বলে আশাবাদ সরকারি এ নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির।
দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় মদ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ প্রতিষ্ঠান কেরু অ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে উৎপাদন দ্বিগুণ করবে কোম্পানিটি। কারণ মদ উৎপাদন করে লাভের মুখ দেখছে প্রতিষ্ঠানটি। এরই ধারাবাহিকতায় কেরু অ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের মতো নতুন পণ্যের ভিন্নতা আনা হবে নর্থবেঙ্গল ও ঠাঁকুরগাঁও চিনিকলে।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান (গ্রেড-১) মো. আরিফুর রহমান অপু জানান, ‘নর্থবেঙ্গল ও ঠাকুরগাঁও চিনিকলের আগের প্রকল্প বন্ধ। নতুন করে প্রকল্প নেওয়া হবে। কারণ প্রকল্প দুটি অনেক আগে অনুমোদন হলেও এই বাজেটে টেন্ডার আহ্বান করে পাওয়া যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘দুটি চিনিকলে অ্যালকোহল উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদেশে এসব অ্যালকোহলের প্রচুর চাহিদা। এজন্য নতুন করে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করা হবে। বর্তমানে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডে অ্যালকোহল তৈরি হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ঠাকুরগাঁও ও নর্থবেঙ্গলে অ্যালকোহল তৈরি করা হবে। এসব প্রোডাক্ট বিদেশে পাঠিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। এছাড়া ওষুধ তৈরির জন্যও কিছু অ্যালকোহল প্রয়োজন হয়। এসব পণ্যও তৈরি করবো। শুধু চিনি বিক্রি করে লাভের মুখ দেখা সম্ভব নয়।’
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৩২৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘নর্থবেঙ্গল চিনিকলে কো-জেনারেশন পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সুগার রিফাইনারি স্থাপন’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ২০২১ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। অথচ ৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা ব্যয়ের পর থমকে আছে প্রকল্পের কাজ। প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ২ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি ১৬ শতাংশ। সবশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে। এরপর একটি টাকাও বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। বর্তমানে প্রকল্পের কাজ বন্ধ। যে উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি নেওয়া হয় তা বাস্তবায়ন হয়নি, অথচ গচ্চা গেছে সরকারের ৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা।
প্রকল্পটি ২০১৪ সালে অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে ৯ বছর। বর্তমানে অনেক ইক্যুইপমেন্টের রেট শিডিউল এক নয়। ফলে অনুমোদিত ব্যয়ে প্রকল্পে ‘প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ারিং’ কাজের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলেও এখন মিলছে না। বারবার দরপত্র আহ্বান করা হলেও কোনো কাজে আসেনি। ফলে প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে।
নর্থবেঙ্গল চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুল আজম জানান, বর্তমানে প্রকল্পের কাজ বন্ধ। নতুনভাবে হয়তো শুরু করতে হবে। প্রকল্পটি যে বাজেটে অনুমোদন হয় সেই বাজেটে দরপত্র মিলছে না। নতুনভাবে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। প্রকল্পও নতুনভাবে নিতে হবে।
৪৮৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘ঠাকুরগাঁও চিনিকলের পুরোনো যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপন ও সুগার বিট থেকে চিনি উৎপাদনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংযোজন’ প্রকল্পটি ২০১৩ সালে একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০২১ সালের জুন মেয়াদে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। একে একে পেরিয়ে গেছে ১০ বছর। অথচ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি মাত্র ১৭ শতাংশ। এর মধ্যে খরচ হয়েছে ১৩ কোটি ৯৬ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। এক দশক আগের রেট শিডিউল ও বর্তমান রেট শিডিউল এক নয়। ফলে প্রকল্পের আওতায় প্রয়োজনীয় মালামাল দরদামে মিলছে না। সবশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৫ লাখ টাকা প্রকল্পের আওতায় ছাড় করা হয়। এরপর এডিপিতে প্রকল্পের আওতায় আর বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ফলে বর্তমানে বন্ধ রয়েছে প্রকল্পের কাজ।
ঠাকুরগাঁও চিনিকলের জিএম (প্রশাসন) মো. সাইফুল ইসলাম জানান, প্রকল্পের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। কিছু গাড়ি কেনা হয়েছিল। এছাড়া কোনো অগ্রগতি নেই। বর্তমানে প্রকল্পের কাজ বন্ধ। কবে শুরু হবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে।’
ঠাঁকুরগাঁও চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহজাহান কবির বলেন, ‘আমি নতুনভাবে এখানে নিয়োগ পেয়েছি। কয়েকদিনের মধ্যে ঠাকুরগাঁও চিনিকলে জয়েন করবো। তবে যতটুকু জানি প্রকল্পের কাজ এখন বন্ধ, চালু থাকলে তো জানতে পারতাম।’
এদিকে, মেয়াদ শেষেও শতভাগ বাস্তবায়ন হয়নি ১৪ চিনিকলের বর্জ্য শোধনাগারের কাজ। চিনিকল এলাকায় মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিতের লক্ষ্যে ১৪ চিনিকলে শুরু হয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপনের কাজ। প্রকল্পের মোট ব্যয় ৮৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০২১ সালের জুন মেয়াদে প্রকল্পের কাজ শতভাগ বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। সেখানে মেয়াদ শেষে অগ্রগতি মাত্র ৬৫ শতাংশ। প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো চিনিকল এলাকায় কৃষিকাজ, জলাশয় ও সেচের পানি কারখানার বর্জ্য থেকে রক্ষা।
পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, সেতাবগঞ্জ (রংপুর), শ্যামপুর (রংপুর), জয়পুরহাট, রাজশাহী, নর্থবেঙ্গল, পাবনা, কুষ্টিয়া, কেরু অ্যান্ড কোং (চুয়াডাঙ্গা), মোবারকগঞ্জ (ঝিনাইদহ), ফরিদপুর, জিল বাংলা (জামালপুর) ও রংপুর সুগার মিলস লিমিটেডে বর্জ্য পরিশোধনাগারগুলো স্থাপন করা হবে। প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন করা হবে আনুষঙ্গিক কিছু কাজ।
বাংলাদেশের একমাত্র অ্যালকোহল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কেরু অ্যান্ড কোং বলছে, গত ছয় মাসে তাদের উৎপাদিত দেশি মদের বিক্রি ৫০ শতাংশ বেড়েছে। একই সঙ্গে দেশে অ্যালকোহলের চাহিদাও বেড়েছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কেরু অ্যান্ড কোং বলছে, নতুন বছরে তারা তাদের উৎপাদন আরও বাড়াচ্ছে।
প্রকল্পের মেয়াদান্তেও শেষ হয়নি কেরু অ্যান্ড কোং (বিডি) লিমিটেডের সংস্কার কাজ। চিনিকলটি সংস্কারে ২০১২ সালে একনেক সভায় ১০২ কোটি ২১ লাখ টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২১ সালের জুন মাসে। অথচ অগ্রগতি মাত্র ৪৫ শতাংশ। প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ মোট ব্যয়ের মধ্যে খরচ হয়েছে মাত্র ২৪ কোটি টাকা। উন্মুক্ত দর পদ্ধতির পরিবর্তে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) সঙ্গে চুক্তি সম্পাদিত হয়। পরবর্তীসময়ে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন মেয়াদ জুন ২০১৫ পর্যন্ত এক বছর বাড়ানো হয়। এরপরও বাস্তবায়ন হয়নি প্রকল্পের কাজ। পরে বিএমটিএফকে দেওয়া এলসি বাতিলের জন্য সোনালী ব্যাংককে অনুরোধ জানানো হয়। এরপরও শতভাগ আলোরমুখ দেখেনি ১০ বছর আগে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের কাজ।